তিস্তাপাড়ে গতকাল অনুষ্ঠিত পদযাত্রাটি শুধু একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি ছিল না, এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে তিস্তা নদীর তীরে এক জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। এই পদযাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান এবং নদীর পরিবেশ রক্ষায় জোর দাবি তোলা। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পরিবেশবাদী কর্মী, কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে এই পদযাত্রা এক নতুন গণজাগরণের সূচনা করেছে।তিস্তাপাড়ে পদযাত্রায় জনতার ঢল: একটি গণআন্দোলনের চিত্র
পদযাত্রার প্রেক্ষাপট
তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের কৃষি নির্ভর জনপদের কৃষকরা এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। তবে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ কমে আসায় কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সরকারী বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ও চুক্তির আলোচনা হলেও সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে জনসাধারণের মনে হতাশা ও ক্ষোভ দানা বাঁধে এবং তারা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়।
পদযাত্রার সূচনা ও আয়োজন
তিস্তা নদীর তীরে অবস্থিত প্রধান শহরগুলোর নাগরিক কমিটি ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এই পদযাত্রার আয়োজন করে। বিভিন্ন স্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এই কর্মসূচির প্রচার করা হয়। সকাল ৯টায় তিস্তা ব্যারেজের পাদদেশ থেকে পদযাত্রাটি শুরু হয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ হাতে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও জাতীয় পতাকা নিয়ে উপস্থিত হন। ‘তিস্তা বাঁচাও, কৃষক বাঁচাও’, ‘নদী রক্ষা কর, ভবিষ্যৎ রক্ষা কর’—এই ধরনের স্লোগানে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে।জনস্রোতের উপস্থিতি
পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক ছাড়িয়ে যায়। বিভিন্ন পেশার মানুষ এতে
স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দল বেঁধে মানুষ পদযাত্রায় যোগ দেন। কৃষকেরা তাদের জমি থেকে সরাসরি এসে এই পদযাত্রায় অংশ নেন। শিক্ষার্থী ও যুবসমাজের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল নৃত্য ও গান পরিবেশন করে পদযাত্রাকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।
নারীদের সক্রিয় ভূমিকা
পদযাত্রায় নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। গ্রামের কৃষাণী থেকে শুরু করে শহরের কর্মজীবী নারী—সবাই একসঙ্গে পদযাত্রায় অংশ নেন। তারা নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হন। নারীদের শক্তিশালী উপস্থিতি পদযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য
পদযাত্রার শেষে একটি সংক্ষিপ্ত জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক কর্মী ও পরিবেশবাদী ব্যক্তিত্ব বক্তব্য রাখেন। এক নেতৃস্থানীয় পরিবেশবিদ বলেন, “তিস্তা নদী শুধু আমাদের সম্পদ নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের প্রতীক। এর রক্ষার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
একজন কৃষক নেতা বলেন, “তিস্তা নদীর পানির অভাবে আমাদের ফসল নষ্ট হচ্ছে। আমরা পানির জন্য আর কাঁদতে চাই না। আমরা সমাধান চাই, আমাদের অধিকার চাই।” বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও তাদের বক্তব্যে তিস্তা নদীর সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
পরিবেশগত প্রভাব
তিস্তা নদীর অবস্থা গত কয়েক বছরে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নদীটি অনেক জায়গায় শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীর পানি কমে যাওয়ায় মাছের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে এবং কৃষিজমিতে চাষাবাদ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিস্তা নদীর অববাহিকায় বসবাসকারী মানুষদের জীবনযাত্রার মান দিন দিন অবনতি ঘটছে। পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা এই পরিবেশগত সমস্যার সমাধানে সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা দাবি করেন।
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও সৃজনশীল প্রতিবাদ
পদযাত্রায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল অংশগ্রহণ করে সৃজনশীল প্রতিবাদ জানান। তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে লেখা গান ও কবিতা পরিবেশন করা হয়। নাট্যদল একটি ছোট নাটক মঞ্চস্থ করে, যেখানে তিস্তা নদীর দূষণ ও পানির অভাবের কারণে মানুষের দুর্দশা তুলে ধরা হয়। এই সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পদযাত্রার গুরুত্ব ও বার্তা জনমনে গভীরভাবে প্রোথিত করে।
মিডিয়ার ভূমিকা
বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এই পদযাত্রাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ পদযাত্রার খবর জানতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই পদযাত্রার ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়। মিডিয়ার এই প্রচারণা পদযাত্রার বার্তা আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
পদযাত্রার পরপরই সরকার একটি বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে তিস্তা নদীর সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ও নদী রক্ষায় নতুন একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। পদযাত্রার নেতারা সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও কার্যকর সমাধান না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান
অনেকেই পদযাত্রায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দাবি তোলেন। বিশেষ করে নদী রক্ষায় বৈশ্বিক সহযোগিতা ও পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করা হয়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ
পদযাত্রার শেষ পর্যায়ে আয়োজক কমিটি ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঘোষণা করে। আগামী দিনে তিস্তা নদীর অন্যান্য অঞ্চলেও পদযাত্রা ও গণজাগরণ কর্মসূচি নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারা বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে আন্দোলনকে আরও বৃহৎ পরিসরে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
উপসংহার
তিস্তাপাড়ের পদযাত্রা শুধু একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি নয়, এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক গণজাগরণ। হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে এই পদযাত্রা একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে যে, নদী রক্ষা ও পানির ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য মানুষ ঐক্যবদ্ধ। সরকারের দায়িত্ব এখন এই বার্তা যথাযথভাবে গ্রহণ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। তিস্তা নদীর ভবিষ্যৎ রক্ষায় এই পদযাত্রা একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
0 Comments